ঘাড়ে ব্যথা হয় যেসব কারণে প্রতিকার
ঘাড়ে ব্যথা এখন খুব পরিচিত একটি সমস্যা। এটি দেখা দিতে পারে যেকোনো বয়সীর ক্ষেত্রেই। কারণ এখন কম-বেশি সবাই মোবাইল, কম্পিউটার ব্যবহার করে থাকেন। দীর্ঘ সময় ঝুঁকে বসে থাকার কারণে ঘাড় ব্যথা দেখা দিতে পারে। অনেক ক্ষেত্রে মাংসপেশিতে টান ধরা, শিরদাঁড়ায় হাড়ের অসুখ, আর্থ্রাইটিস, সারভাইকাল স্পন্ডিলসিস, ইত্যাদি অসুখ থেকেও ঘাড়ের ব্যথা হতে পারে।
অন্যান্য ব্যথার মতোই ঘাড় ব্যথাও যথেষ্ট অস্বস্তিকর। ঘাড় ব্যথা দেখা দিলে অন্য কোনো কাজে মন দেয়া দুষ্কর হয়ে পড়ে। বিশেষজ্ঞদের মতে, ঘাড় ব্যথা চিকিৎসার মূল কৌশল হল ব্যায়াম, ধ্যান এবং সঠিক শারীরিক অঙ্গবিন্যাস। এসবে কাজ না হলে তখন চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়া জরুরি। ঘাড় ব্যথা থেকে মুক্তি পেতে কী করতে হবে, তা প্রকাশ করেছে বোল্ডস্কাই।
Table of Contents
- ঘাড়ে ব্যথা হয় যেসব কারণে প্রতিকার
- কেন হয় ঘাড়ব্যথা
- ঘাড় ব্যথা কমানো বা নিরাময়ের উপায়
- ঘাড় ব্যথা কমাতে ব্যায়াম
- নিজেই করুন প্রতিকার
- ঘরোয়া প্রতিকার
- পরিশেষ
আরও পড়ুন — পেট ব্যথা কমানোর ঘরোয়া উপায়
কেন হয় ঘাড়ব্যথা
- বয়স হলে ঘাড়ের টিস্যু ক্ষয় হয়ে যায়। দীর্ঘদিন ধরে ল্যাপটপের সামনে বসে যাঁরা কাজ করেন, তাঁদের এ সমস্যা বেশি হয়। এর কারণে ঘাড়ের মধ্যকার হাড়ে ফাঁক থেকে যায়। যাঁদের সারভাইকাল স্পন্ডেলাইটিস (ঘাড়ে মেরুদণ্ডের অংশে হাড়ক্ষয়) রয়েছে, তাঁদেরও ঘাড়ে ব্যথা হতে পারে।
- কোনো কারণে স্পাইনাল কর্ডের কোনো টিস্যু ফুলে গেলে স্লিপ ডিস্ক হতে পারে। সেখান থেকেও ঘাড়ে ব্যথা হয়।
- কোনো দুর্ঘটনায় ঘাড়ে আঘাত পেলে সেই ব্যথা বহুদিন স্থায়ী হয়। পেশিতে টান লাগলে মাঝেমধ্যেই তখন ব্যথা বাড়ে।
- বসার ভঙ্গিতে ত্রুটি থাকলে ঘাড়ে ব্যথা হতে পারে। বাঁকাভাবে শুয়ে থাকলে ঘাড়ে চাপ পড়ে, সেখান থেকেও ঘাড়ব্যথা হতে পারে। এ ধরনের সমস্যা হলে অন্যদিকে ঘাড় ঘোরানো অসম্ভব হয়ে পড়ে।
- মানসিক অবসাদ ও দুশ্চিন্তা থেকেও ঘাড়ের ব্যথা হতে পারে।
- অনেক সময় বিছানায় শুয়ে বই পড়া, টিভি দেখা বা উপুড় হয়ে ল্যাপটপে কাজ করা থেকেও ঘাড়ের পেশিতে টান লেগে ব্যথা হয়।
ঘাড় ব্যথা কমানো বা নিরাময়ের উপায়
ঘাড় ব্যথা কিংবা ঘাড় পুরোপুরি ঘোরাতে না পারার সবচাইতে কার্যকর উপায় হলো আলতোভাবে ঘাড় টান টান করার চেষ্টা করা। খুব সাবধানে ধীরে ধীরে পুরো ঘাড়টা চারপাশে গোলাকারে ঘোরাতে হবে। তবে ব্যথা লাগলে থেমে যেতে হবে, জোর করা যাবে না।
‘ইট দিস নট দ্যাট ডটকম’য়ে প্রকাশিত প্রতিবেদনে আরও জানানো হয়, ঘাড় টান টান করার জন্য চোয়াল দিয়ে বুক স্পর্শ করার আবার মাথা পেছন দিকে যতদূর সম্ভব হেলিয়ে দিতে পারেন। ঘাড় একবারে আটকে গেলে হাত দিয়ে মাথা ধরে ধীরে ধীরে ঘোরানোর চেষ্টা করতে হবে। তবে জোর করা যাবে না, ব্যথা পেলেই থামতে হবে।
যারা দীর্ঘ সময় চেয়ার টেবিলে বসে কাজ করেন, তাদের ঘাড় ব্যথা হওয়া খুবই স্বাভাবিক। তাই নিয়মিত ‘স্ট্রেচিং’ বা ঘাড় টান টান করতে হবে। তবে ‘স্ট্রেচিং’য়ের চেষ্টা না করলেও যদি অসহ্য ব্যথা অনুভব করেন তবে ঘাড়ের ব্যথায় পেছনের কারণটা হয়ত গুরুতর কিছু।
আরও পড়ুন — মাথা ব্যথা কমানোর ১০টি ঔষধের নাম জেনে নিন
ঘাড় ব্যথা কমাতে ব্যায়াম
এই ব্যথা নিরাময়ের সবচাইতে কার্যকর উপায় হল ঘাড়ের শক্ত হওয়া পেশি টান টান করা। যদি ব্যায়ামের মাধ্যমে ঘাড় ব্যথা থেকে আরাম পেতে হয়, তবে শরীরের ‘পশ্চার’ বা ভঙ্গী সঠিক করে এমন ব্যায়াম করতে হবে।
এই ‘পশ্চার কারেক্টিং এক্সারসাইজ’গুলো ‘মাসকুলোস্কেলেটাল পেইন’ সারাতে উপকারী এমন দাবি করেন বিশেষজ্ঞরা।
এমন ব্যায়ামের মধ্যে যোগ ব্যায়াম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। মূলত মেরুদণ্ড প্রসারিত হয় এবং শ্বাস-প্রশ্বাসের ওপর জোর বেশি দেয় এমন ব্যায়ামগুলোই এখানে মূখ্য, যা শরীরের ‘পশ্চার’ ঠিক করে। ব্যায়ামগুলো অবশ্যই নিয়মিত করে যেতে হবে।
নিজেই করুন প্রতিকার
প্রতিদিনকার রুটিনে কিছু পরিবর্তন এনে সাধারণ ঘাড়ব্যথার প্রতিকার করা যায়।
- শারীরিক ভঙ্গি স্বাস্থ্যকর করুন। বসে থাকার সময় আপনার মেরুদণ্ড যেন সরলরেখায় থাকে এবং কান সরাসরি আপনার কাঁধের ওপরে থাকে।
- দীর্ঘ সময় একটানা বসে কাজ না করে এক ঘণ্টা পরপর ১০ মিনিট বিরতি নিন। যদি দীর্ঘ দূরত্বে ভ্রমণ করেন বা দীর্ঘ সময় ধরে কম্পিউটারে কাজ করেন, তবে উঠে পড়ুন, ঘুরে দেখুন এবং ঘাড় ও কাঁধ সামনে–পেছনে প্রসারিত করুন।
- কাজের টেবিল–চেয়ার ও কম্পিউটার এমনভাবে সামঞ্জস্য করুন, যাতে মনিটর চোখের স্তরের সমান থাকে। দুই হাঁটু হিপের কিছুটা নিচে থাকবে। চেয়ারে আর্মরেস্ট বা হাতল ব্যবহার করা যেতে পারে। টেবিলে কুঁজো হয়ে বসবেন না।
- মুঠোফোনে কথা বলার সময় কান ও কাঁধের মধ্যে ফোনটি ঠেকিয়ে রাখবেন না। প্রয়োজনে হেডফোন বা ফোনের স্পিকার অন করে নিন।
- ধূমপায়ীরা ঘাড়ে ব্যথা হওয়ার উচ্চ ঝুঁকিতে থাকেন। তাই ঘাড়ব্যথা থেকে মুক্ত থাকতে ধূমপান ছেড়ে দিন।
- কাঁধের ওপর স্ট্র্যাপসহ ভারী ব্যাগ বহন এড়িয়ে চলুন। অতিরিক্ত ওজন ঘাড়ে চাপ তৈরি করে ব্যথার সৃষ্টি করে।
- মাঝারি-শক্ত সমান বিছানায় এক বালিশে চিত হয়ে ঘুমাতে হবে। ঘুমানোর সময় ঘাড়ের নিচে বালিশ দিতে হবে। দরকার হলে বালিশ টেনে নামিয়ে ঘাড়ের নিচে নিন বা কম উচ্চতার বালিশ ব্যবহার করুন, যাতে আপনার মেরুদণ্ডের পেশি সমতল থাকে।
- সাইকেল চালানো কিংবা সাঁতার কাটার মতো পরিশ্রমের কাজ অনেক বেশি সময় ধরে করলে ব্যথা আরও বেড়ে যায়। তাই একটানা না করে মাঝেমধ্যে বিরতি নিতে হবে।
আরও পড়ুন — ১০টি সাত দিনে চিকন হওয়ার উপায় জানুন ২০২৪
ঘরোয়া প্রতিকার
ম্যাসাজ:
যেকোনো ব্যথা কমাতে ম্যাসাজ কার্যকরী। ঘাড় ব্যথা হলেও এটি মেনে চলতে পারেন। ব্যথা দূর করতে নারিকেল তেল অথবা অলিভ অয়েল হালকা গরম করে ঘাড় ও কাঁধে মেখে নিন। এরপর এটি ম্যাসাজ করুন। এভাবে ১০ মিনিট ম্যাসাজ করুন। ব্যথা থেকে মুক্তি মিলবে সহজেই।
আইস:
ব্যথা দূর করতে ব্যবহার করতে পারেন আইস প্যাক। কারণ শীতল তাপমাত্রা প্রদাহ হ্রাস করতে এবং ব্যথা উপশম করতে সাহায্য করে। বরফের টুকরো গ্লাসে বা প্যাকেটে ভরে ব্যথা জায়গায় ধরতে পারেন। এভাবে সারাদিনে দুই থেকে তিন বার করে ১৫ মিনিটের জন্য দিতে থাকুন। ব্যথা কমবে।
লবণ-পানিতে গোসল:
মাংসপেশি টান ধরা থেকে যদি ঘাড়ের ব্যথা হয়ে থাকে, তবে গরম পানিতে ঈপসম সল্ট মিশিয়ে গোসল করতে পারেন। এই ঈপসম সল্টে থাকা সালফেট ম্যাগনেসিয়াম মাংসপেশীকে শিথিল করে ফোলা এবং ব্যথা কমাতে সহায়তা করে। এটি মানসিক চাপ কমানোর পাশাপাশি রক্ত সঞ্চালন সচল রাখে।
আরও পড়ুন — ব্যায়াম করার ৯টি উপকারী দিক সম্পর্কে জেনে নিন
আপেল সাইডার ভিনেগার:
আপেল সাইডার ভিনেগারে শক্তিশালী অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট এবং অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামেটরি বৈশিষ্ট্য রয়েছে যা শরীরের যেকোনো ব্যথা থেকে মুক্তি দিতে পারে। গরম পানিতে ভিনেগার মিশিয়ে ব্যথাযুক্ত জায়গায় মালিশ করুন অথবা এই ভিনেগারে একটি তোয়ালে ভিজিয়ে ব্যথার জায়গায় রাখুন। উপকার মিলবে।
ব্যায়াম:
ঘাড়ের এমন কিছু ব্যায়াম যা ব্যথা হ্রাস করতে সাহায্য করতে পারে। ব্যায়াম করার আগে মাংসপেশীকে প্রসারিত করার জন্য গরম সেঁক দিয়ে দিন। এরপর আপনার ঘাড বৃত্তাকার গতিতে একবার ক্লক ওয়াইজ এবং আবার অ্যান্টি ক্লক ওয়াইজ ঘোরান। এবার ঘাড় আস্তে আস্তে পিছনে এবং সামনে, আবার একবার ডান পাশ ও একবার বাম পশে ঘোরান। এভাবে ১৫ মিনিট করে দিনে ৩-৪ বার করুন। ব্যথা দূর হবে।
আরও পড়ুন — চুলকানি দূর করার ক্রিম নাম এবং দাম কত
পরিশেষ
ব্যথানাশক লোকাল স্প্রে, জেল দিয়ে ভালোভাবে মালিশ করলে রক্ত সঞ্চালন স্বাভাবিক হয়। আবার হালকা গরম পানিতে গোসল করে তারপর জলপাই বা নারকেল তেল হালকা গরম করে কিছুক্ষণ মালিশ করতে পারেন। সকাল ও বিকেল—দুই বেলা মালিশ করলে আরাম পাবেন। মালিশের মাধ্যমেও ঘাড়ব্যথা থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। এ ক্ষেত্রে সঠিক ও অভিজ্ঞ হাতে মালিশ করাতে হবে। তবে এটা দীর্ঘস্থায়ী সমাধান নয়।