আমি কিংবদন্তির কথা বলছি কবিতার ব্যাখ্যা ও মূলভাব।
কবি পরিচিতি: কবি আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ ১৯৩৪ খ্রিষ্টাব্দের ৮ই ফেব্রুয়ারি বরিশাল জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ইংরেজি সাহিত্য বিষয়ে বিএ ও এমএ পাশ করেন। পরে কিছুদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেন। অতঃপর তিনি সিভিল সার্ভিসে যোগ দেন। তাঁর কবিতার মধ্যে বেশি প্রাধান্য পেয়েছে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন এবং মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন-এই বিষয়ক সাহিত্য রচনায় অবদান রাখার রাখার কারণে একুশে পদক লাভ করেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ হলো: সাত নরীর হার, কখনো রং কখনো সুর, আমি কিংবদন্তির কথা বলছি, কমলের চোখ, বৃষ্টি ও সাহসী, আমার সময়, পুরুষের জন্য প্রার্থনা ইত্যাদি। কবি আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ ২০০১ খ্রিষ্টাব্দের ১৯ মার্চ মৃত্যুবরণ করেন।
আমি কিংবদন্তির কথা বলছি কবিতার ব্যাখ্যা ও মূলভাব
আমি আমার পূর্বপুরুষের কথা বলছি
তাঁর করতলে পলিমাটির সৌরভ ছিল
তাঁর পিঠে রক্তজবার মতো ক্ষত ছিল।
আমি কিংবদন্তির কথা বলছি কবিতার ব্যাখ্যা: আমাদের পূর্ব পুরুষদের ইতিহাস “আমি কিংবদন্তির কথা বলছি” -এই কবিতার মাধ্যমে তুলে ধরা হয়েছে। আমাদের পূর্বপুরুষদের হাতে (কর) পলিমাটির সৌরভ ছিল। যদ্যপি আমাদের পূর্বপুরুষেরা প্রধানত জীবিকার দিক দিয়ে কৃষির উপর নির্ভর ছিল; তথাপি আমাদের বাঙালির ইতিহাস শুধুই কৃষিজীবীদের ইতিহাস নয়। আমাদের বাঙালির ইতিহাস হাজার বছরের শোষণের ইতিহাস। ইংরেজরা আমাদের শোষণ করেছে; পাকিস্তানীরা আমাদের শোষণ করেছে। সেজন্য কবি আমাদের ’পূর্বপুরুষের পিঠে রক্তজবার মতো ক্ষত’ উপমাটি ব্যবহার করেছে।
তিনি অতিক্রান্ত পাহাড়ের কথা বলতেন
অরণ্য এবং শ্বাপদের কথা বলতেন
পতিত জমি আবাদের কথা বলতেন
তিনি কবি এবং কবিতার কথা বলতেন।
জিহ্বায় উচ্চারিত প্রতিটি সত্য শব্দ কবিতা
কর্ষিত জমির প্রতিটি শস্য দানা কবিতা।
আরও পড়ুনঃ
আমি কিংবদন্তির কথা বলছি কবিতার ব্যাখ্যা: তিনি পাহাড় অতিক্রম করার মতো অসাধ্য কষ্ট করার কথা বলতেন। দুর্গম পাহাড় পাড়ি দেওয়ার কথা তিনি বলতেন। তিনি বন-জঙ্গল এবং হিংস্র জন্তুর কথা বলেছেন—কারণ: যখন আমরা কোনো একটা ভালো কর্ম করতে যাব; তখন নানা ধরণের বাধা-বিপত্তি আসতে পারে। যার দরুণ পূর্বপুরুষেরা আমাদের সতর্ক করে দিচ্ছে। তিনি এতোটাই সংগ্রামী ছিলেন যে পরিত্যাক্ত জমির মধ্যেও ফসল ফলানোর কথা বলতেন। সুতরাং আমরা বুঝতে পেরেছি – আমাদের এতোটাই সংগ্রামের ইতিহাস রয়েছে। তাঁর অন্যায়ের বিরুদ্ধে উচ্চারিত প্রতিটি তেজস্বী সত্য শব্দই হচ্ছে কবিতা। আমাদের অত্যাচারিত হওয়ার পরে অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের প্রতিটি শব্দই কবিতা। আমাদের জমির প্রতিটি শস্যদানাই হচ্ছে কবিতা; আমাদের জীবনে শস্যদানা যেমন গুরুত্বপূর্ণ; তেমনই মুক্তির প্রত্যাশা প্রয়োজন। এখানে ’কবিতা’ শব্দটির মধ্য দিয়ে মুক্তির প্রত্যাশা ব্যক্ত করা হয়েছে।
যে কবিতা শুনতে জানে না
সে ঝড়ের আর্তনাদ শুনবে।
যে কবিতা শুনতে জানে না
সে দিগন্তের অধিকার থেকে বঞ্চিত হবে।
যে কবিতা শুনতে জানে না
সে আজন্ম ক্রীতদাস থেকে যাবে।
আমি কিংবদন্তির কথা বলছি কবিতার ব্যাখ্যা: যার মধ্যে মুক্তির আকাঙ্ক্ষা নেই ( যে কবিতা শুনতে জানে না); মহাবিপদের মুখোমুখি হবে। যার মধ্যে সত্য বলার সদ্সাহস নেই; সে তার অধিকার থেকে বঞ্চিত হবে। আমাদের যদি মুক্তির প্রত্যাশা না থাকে; তাহলে আমাদের সারাজীবন অন্যের গোলাম হয়ে থাকতে হবে। আমাদের অন্যায়ের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করার তীব্র বাসনা থাকতে হবে।
আমি উচ্চারিত সত্যের মতো
স্বপ্নের কথা বলছি।
উনোনের আগুনে আলোকিত
একটি উজ্জ্বল জানালার কথা বলছি।
আমি আমার মায়ের কথা বলছি,
তিনি বলতেন প্রবহমান নদী
যে সাঁতার জানে না, তাকেও ভাসিয়ে রাখে।
যে কবিতা শুনতে জানে না
সে নদীতে ভাসতে পারে না।
যে কবিতা শুনতে জানে না
সে মাছের সঙ্গে খেলা করতে পারে না।
যে কবিতা শুনতে জানে না
সে মায়ের কোলে শুয়ে গল্প শুনতে পারে না।
আরও পড়ুনঃ
ফরেক্স ট্রেডিং কি এবং কিভাবে ফরেক্স ট্রেডিং করে আয় করবেন
আমি কিংবদন্তির কথা বলছি কবিতার ব্যাখ্যা: তিনি এমন এক স্বপ্নের কথা বলেছেন যেখানে সবাই মুক্ত থাকবে। সবাই স্বাধীনভাবে চলাফেরা করতে পারবে। যদি অবস্থা ভালো থাকে বা অনুকূল অবস্থা থাকে; এবং যদি মানুষের মাঝে তীব্র আকাঙ্ক্ষা থাকে—তবে বয়ে চলে এমন নদী থেকে বেঁচে ফিরতে পারবে—ভেসে থাকতে পারবে। কিন্তু যিনি পরিশ্রম করতে পারে না—সত্য বলার আকাঙ্ক্ষা থাকে না; তিনি বিপদের মধ্যখান থেকে বেঁচে ফিরতে পারে না। যার ভেতরে ভালোদিনের আশা নেই; সে তার জীবনকে অনিন্দ্য সুন্দরভাবে সাজিয়ে-গুছিয়ে উপভোগ করতে পারে না।
আমি কিংবদন্তির কথা বলছি
আমি আমার পূর্ব পুরুষের কথা বলছি।
আমি বিচলিত স্নেহের কথা বলছি
গর্ভবতী বোনের মৃত্যুর কথা বলছি
আমি আমার ভালোবাসার কথা বলছি।
ভালোবাসা দিলে মা মরে যায়
যুদ্ধ আসে ভালোবেসে
মায়ের ছেলেরা চলে যায়,
আমি আমার ভাইয়ের কথা বলছি।
আমি কিংবদন্তির কথা বলছি কবিতার ব্যাখ্যা: এখানে কবি তাঁর পূর্বপুরুষদের কথা বলছেন—তাঁদের সাহসী এবং গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসের কথা বলা হয়েছে। মুক্তির জন্য পূর্বপুরুষেরা ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং তাঁদের জন্য আপনজনেরা উদ্বিগ্ন। পারিবারের স্নেহ ত্যাগ করে তাঁরা অন্যায়ের বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। তাঁরা গর্ভবতী বোনের মৃত্যু দেখেছে। মুক্তিপ্রত্যাশি জাতিকে দাবিয়ে রাখার জন্য জন্য শত্রুরা গর্ভবতী বোনকে হত্যা করতে দেখেছে তবুও পূর্বপুরুষদের দমিয়ে রাখতে পারেনি শত্রুরা। যদি মায়ের প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ করতে গিয়ে দেশমাতাকে শত্রুর হাতে তুলে দিই; তবে আমরা আমাদের দেশমাতাকে রক্ষা করতে পারব না। সুতরাং, পরিবারকে ভালোবাসা দিলে দেশ পরাধীন হয়ে যায়। যুদ্ধ আসলে দেশের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য দামাল ছেলেরা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে।
যে কবিতা শুনতে জানে না
সে সন্তানের জন্য মরতে পারে না।
যে কবিতা শুনতে জানে না
সে ভালোবেসে যুদ্ধে যেতে পারে না।
যে কবিতা শুনতে জানে না
সে সূর্যকে হৃদপিন্ডে ধরে রাখতে পারে না।
আমি কিংবদন্তির কথা বলছি
আমি আমার পূর্ব পুরুষের কথা বলছি।
তাঁর পিঠে রক্তজবার মত ক্ষত ছিল
কারণ তিনি ক্রীতদাস ছিলেন।
আরও পড়ুনঃ
পাল শাসনামলের গুরুত্বপূর্ণ দিক কী কী
আমি কিংবদন্তির কথা বলছি কবিতার ব্যাখ্যা: যার মধ্যে সত্য বলার সাহস থাকবে না বা যার মধ্যে মুক্তির জন্য আকাঙ্ক্ষা থাকবে না; সে সন্তানের জন্য নিজেকে উৎসর্গ করতে পারবে না। যার মধ্যে সত্য বলার দীপ্ত সাহস থাকবে না; সে ভালোবেসে দেশকে রক্ষা করার জন্য যুদ্ধে যেতে পারবে না। যে কবিতা শুনতে পারে না; সে সূর্যের মতো তাঁর নিজের শক্তিকে দীপ্তিমান করতে পারে না। আমার পূর্বপুরুষদের পিঠে রক্তজবার মতো দাগ ছিল; কারণ আমার পূর্বপুরুষেরা শোষিত-নির্যাতিত-নিপীড়িত ছিল। ইংরেজরা এদেশকে শোষণ করেছে প্রায় দুইশত বছর—পাকিস্তানিরা এদেশকে শোষণ করেছে প্রায় তেইশ বছর। সুতরাং, আমার পূর্বপুরুষেরা লাঞ্ছিত ছিলেন।
যে কর্ষণ করে
শস্যের সম্ভার তাকে সমৃদ্ধ করবে।
যে মৎস্য লালন করে
প্রবহমান নদী তাকে পুরস্কৃত করবে।
যে গাভীর পরিচর্যা করে
জননীর আশীর্বাদ তাকে দীর্ঘায়ু করবে।
যে লৌহখন্ডকে প্রজ্জ্বলিত করে
ইস্পাতের তরবারি তাকে সশস্ত্র করবে।
আমি কিংবদন্তির কথা বলছি কবিতার ব্যাখ্যা: যে চাষ করে; সে ভালো শস্য লাভ করে। যে মাছ পালন করবে; সে পুরস্কার পাবে। যে গাভীর পরিচর্যা করবে; সে আশানুরূপ ফল লাভ করবে। এই লাইনগুলোর মধ্য দিয়ে কবি বুঝাতে চেয়েছেন যে, যদি তুমি কষ্ট করো; তবে তুমি ভালো ফল লাভ করবে। যদি তুমি প্রচেষ্টা করো; তবে তুমি বিফলে যাবে না।
দীর্ঘদেহ পুত্রগণ
আমি তোমাদের বলছি।
আমি আমার মায়ের কথা বলছি
বোনের মৃত্যুর কথা বলছি
ভাইয়ের যুদ্ধের কথা বলছি
আমি আমার ভালবাসার কথা বলছি।
আমি কবি এবং কবিতার কথা বলছি।
সশস্ত্র সুন্দরের অনিবার্য অভ্যুত্থান কবিতা
সুপুরুষ ভালবাসার সুকণ্ঠ সংগীত কবিতা
জিহ্বায় উচ্চারিত প্রতিটি মুক্ত শব্দ কবিতা
রক্তজবার মতো প্রতিরোধের উচ্চারণ কবিতা।
আমি কিংবদন্তির কথা বলছি কবিতার ব্যাখ্যা: দীর্ঘদেহ বিশিষ্ট অনাগত পুত্রদের আাবার স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন বাঙালিদের নির্যাতনের ইতিহাস। এই ইতিহাসে মিশে আছে আমাদের বোনের মৃত্যু; আমাদের মায়ের মৃত্যু; আমাদের মায়েদের ছেলে হারানোর যন্ত্রণা। অশেষ ত্যাগ-তিতিক্ষার মাধ্যমে আমাদের ইতিহাস রচিত হয়েছে। কবি আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ কবিতার মধ্যেই সকল মুক্তির উৎস খুঁজে পায়। কবিতার মধ্য দিয়ে তাঁরা যুদ্ধ করার জন্য অনুপ্রেরণা লাভ করেন। কবির মতে, জীবনকে বিলীন করে দিয়ে বা জীবনকে বিসর্জন দিয়ে অন্যায়ের প্রতিবাদ করা বা অন্যায়ের সাথে আপস না করার নামই কবিতা।
আমরা কি তাঁর মতো কবিতার কথা বলতে পারবো।
আমরা কি তাঁর মতো স্বাধীনতার কথা বলতে পারবো।
আমি কিংবদন্তির কথা বলছি কবিতার ব্যাখ্যা:
কবিতার শেষপ্রান্তে এসে কবি পূর্বপুরুষদের ইতিহাসের কথা জানান দিয়ে কবি আমাদের কাছে সংশয়ের সুরে বলছেন; আমরা আমাদের পূর্বপুরুষের দেখানো পথে চলতে পারবো কি-না । কবির ভাষ্যমতে, পূর্বপুরুষের মতো যদি আমরা সংগ্রাম করতে না পারি; আমাদের স্বাধীনতা যদি অক্ষত রাখতে না পারি, তবে জীবন অর্থবহ হবে না। আমাদের সমাজের অন্যায়কে প্রতিহত করে আমাদের সমাজকে রক্ষা করার মাধ্যমেই একটি অর্থবহ জীবনের সন্ধানই এই কবিতার মূল বিষয়বস্তু।